ড. আহমদ আবদুল কাদের।।

অতি সম্প্রতি আমাদের সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। এ মূর্তি স্থাপন নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। দেশের আলেম সমাজ বলছে এটি হচ্ছে গ্রিক দেবী থেমিসের মূর্তি যা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। আর এটর্নি জেনারেল বলছেন, এটি মূর্তি নয়- এটি স্কাল্পচার। চিহ্নিত ইসলামবিদ্বেষী মহলটিতো মূর্তির বিরোধিতাকে ‘মুক্তিযুদ্ধের’ চেতনাবিরোধী বলে দাবি করছে!

থেমিস দেবী : প্রাচীনকালে অনেক দেশেই ন্যায়বিচারককে দেবী কল্পনা করা হতো এবং তার পুজা অর্চণা করা হতো। সব পৌত্তলিক জাতিই বিশ্বস্রষ্টার মহান সব গুণ এবং কার্যাবলীকে স্বতন্ত্র দেবদেবী বলে আখ্যায়িত করতো। এবং বিমূর্ত গুণাবলীকে মূর্ত রূপ দিয়ে মূর্তি তৈরি করা হতো। এসব মূর্তিকে উপাস্য জ্ঞানে পূজা-উপাসনা করা হতো। প্রাচীন গ্রিসেও তেমনি করে পৌত্তলিকতার আখড়া বসেছিল। গ্রিসের বিভিন্ন শহরের জন্য বিভিন্ন দেবদেবী কল্পনা করা হয়েছিল। কোন কোন ক্ষেত্রে কিছু কিছু সাধারণ দেবদেবীও ছিল, কোথাও আবার ভিন্ন ভিন্ন ছিল দেবদেবী। কেউ যুদ্ধের, কেউ শান্তির, কেউ সমৃদ্ধির, কেউবা সৌন্দর্যের ইত্যাদি। ন্যায়বিচারের জন্যও গ্রিকরা একজন দেবীর কল্পনা করেছিল। দেবীর নাম দিয়েছিল থেমিস। গ্রিক পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে খ্রিস্টপূর্ব ৮ম শতকে টিটান দেবদেবীর একজন ছিল থেমিস। প্রথমে থেমিস ছিল প্রাকৃতিক নিয়ম ও আইনের দেবী। প্রাকৃতিক নিয়মই হচ্ছে সুবিচারের প্রকাশ। তাই থেমিস হয়ে দাঁড়ালো ন্যায়বিচারের দেবী। তারা তার মূর্তি গড়ে নিয়েছিল। এসব মূর্তির আকার আকৃতি তথা দৈহিক গড়ন সম্পর্কে পৌরাণিক কাহিনীগুলোতে নানা বর্ণনা রয়েছে। এসব দেবদেবীর পিতা-পিতামহ, সন্তান-সন্ততি ইত্যাদির বর্ণনাও রয়েছে গ্রিক পৌরাণিক কাহিনীতে।

অনুরূপভাবে খ্রিস্টীয় ১ম শতকে এসে রোমানরা ন্যায় বিচারের দেবীর নাম দেয় জাস্টিসিয়া বা লাস্টিসিয়া। খ্রিস্টীয় ২২ সালে রোমান মুদ্রায় দেবী জাস্টিসিয়ার মূর্তি অংকিত হয়। ন্যায়বিচারের গ্রিক দেবী থিমিস যাকে রোমানরা বলতো জাস্টিসিয়া বা লাস্টিসিয়া। দেবী থেমিস বা জাস্টিসিয়ার মূর্তিটি একজন নারীর। তার ডান হাতে আছে একটি তরবারি। বাম হাত আছে একটি দাঁড়ি পাল্লা। তার চোখ দুটো খোলা। ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসাবে দাঁড়িপাল্লার ধারণা আরো অনেক পুরনো। প্রাচীন মিশরের দেবী মাত বা আরো পরে দেবী উরুস এর হাতে ছিল ন্যায়ের প্রতীক দাঁড়িপাল্লা। প্রাচীন মিশরের দাঁড়িপাল্লা গ্রিসে এসে দেবী থেমিসের হাতে উঠে। আরো পরে রোমানদের কাছে দেবী জাস্টিসিয়ার বাম হাতে দাঁড়িপাল্লা ও ডান হাতে তরবারি দেখা যায়। দেবীর এই অবয়বটিই ২২ সালে প্রথম রোমান মুদ্রায় অংকিত হয়।

আধুনিক ইউরোপে দেবী জাস্টিসিয়া : ১৬-১৭শ শতকে ইউরোপে পুনর্জাগরণের সময়ে প্রাচীন গ্রিক-রোমান ক্লাসিক্যাল যুগের ভাষা সাহিত্য, শিল্প, বিজ্ঞান, দর্শন ইত্যাদিও চর্চা শুরু হয়। সেসময় ইউরোপ সাধারণভাবে গ্রিক-রোমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গ্রহণ করে নেয়। তবে যেহেতু ইউরোপে খ্রিস্টধর্মের প্রাধান্য ছিল তখন ধর্ম হিসাবে পৌত্তলিকতা গ্রহণ না করলেও গ্রিক-রোমান পৌত্তলিক ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধর্মনিরপেক্ষতার আড়ালে গ্রহণ করে নেয়। তখন তারা দেব দেবীর মূর্তিকে নাম দেয় ভাস্কর্য শিল্প। তারা বলতে থাকে যে এসব ভাস্কর্য হচ্ছে বিভিন্ন বিষয়ের ও গুণাবলীর প্রতীকী মূর্তরূপ। এসব ব্যাখ্যার আড়ালে তারা মূলত গ্রিক-রোমান পৌত্তলিক ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে আত্মস্থ্য করে নেয়। একইভাবে থেমিস দেবী বা দেবী জাস্টিসিয়ার মূর্তি হয়ে উঠলো ন্যায়বিচারের প্রতীকীরূপ। তারা দেবীর আনুষ্ঠানিক পূজা অর্চনা করলো না বটে তবে দেবীর মূর্তিতে এক ধরনের পবিত্রতার আবহ তৈরি করা হলো। এসব মূর্তি শিল্পের নামে বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করা হতে থাকে। এমনকি ফরাসী বিপ্লবোত্তর সন্ত্রাসের রাজত্বকালীন সময়ে ফ্রান্সের প্রধান গীর্জাকে বন্ধ করে দিয়ে তথাকথিত ‘যুক্তিদেবী’র মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এবং ধর্মের ঐতিহ্যানুসারে যথারীতি ‘যুক্তিদেবীর’ প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ পেশ করা হতে থাকে। এক কথায় ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র নামে মূলত প্রাচীন গ্রিসের পৌত্তলিক সংস্কৃতিরকে আত্মস্থ করে নেয়া হলো। তাই দেখা যায় আমাদের দেশের সেক্যুলারপন্থীরা, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরাও ইসলামের ব্যাপারে যতটা অসহনশীল ও বিদ্বেষী পৌত্তলিক সংস্কৃতি ও ধর্মের প্রশ্নে ততই আগ্রহী ও উৎসাহী।

লেডি জাস্টিস : বর্তমানে নির্মিত বা স্থাপিত থেমিস বা জাস্টিসিয়ার মূর্তিকে বলা হয় লেডি জাস্টিস। গ্রিক-রোমান প্যাগান যুগের দেবী ছিল থেমিস বা জাস্টিসিয়া। আর খ্রিস্টীয় রোমান যুগে প্যাগান যুগের দেবীকে বা দেবী মূর্তিকে মেনে নেয়া স্বাভাবিকভাবেই সম্ভব ছিল না। তাই দীর্ঘদিন পর্যন্ত গ্রিক দেবী মূর্তিকে খৃস্ট জগৎ মেনে নেয়নি। কিন্তু ইউরোপীয় রেনেসাঁর ফলে ইউরোপে খ্রিস্টধর্মের প্রভাব খর্ব হতে থাকে। এই সময় আবির্ভাব ঘটে একদল সেক্যুলার চিন্তাবিদ আর খোদাই শিল্পীর। তারা প্রাচীন গ্রিক-রোমান সংস্কৃতি, ঐহিত্য ও শিল্পকলার পুনর্জীবন ঘটায়। পুনর্জীবনের এক পর্যায়ে দেবী থেমিস বা জাস্টিসিয়ার মূর্তিরও পুনর্জীবন ঘটে। তবে তা ঘটে অন্য নামে। থেমিসের মূর্তি বা দেবী জাস্টিসিয়ার মূর্তির নাম হয়ে যায় লেডি জাস্টিস। যেহেতু দেবী থেমিস বা দেবী জাস্টিসিয়াকে কল্পনা করা হয়েছিল একজন নারী হিসাবে। তাই সুবিচারের নারী মূর্তির ভাস্কর্যকে বলা হলো লেডি জাস্টিস।অথচ, সে সময় গোটা ইউরোপে কোন নারী বিচারপতির অস্তিত্ব ছিল না। তবু বিচারের প্রতীক হিসাবে নারীর ভাস্কর্যকে মেনে নেয়া হলো এবং তার এক হাতে ন্যায়ের দ- দাঁড়িপাল্লা, অন্য হাতে শাস্তিদানের প্রতীক তরবারি দেয়া হলো। চোখ বেঁধে রাখার বিষয়টি প্রাচীন গ্রিস-রোমানে ছিল না। রোমান মুদ্রায় যে দেবী জাস্টিসিয়ার ছবি অংকিত ছিল তার ছিল খোলা চোখ বাম হাতে ছিল দাঁড়িপাল্লা ও ডান হাতে ছিল তরবারি। এমনকি ১৯০২ সালে নির্মিত লন্ডনের ফৌজদারী আদালত ভবনের শীর্ষে স্থাপিত লেডি জাস্টিসের ব্রোঞ্জ মূর্তির চোখ খোলা রাখা হয়েছে। কবে থেকে চোখ বাঁধার প্রথা চালু হলো তা সুনির্দিষ্ট নয় তবে যতদূর জানা যায় যে ১৫৪৩ সালে সুইজারল্যান্ডের বার্নেতে স্থাপিত লেডি জাস্টিসের ভাস্কর্য ছিল চোখ বাঁধা। ধারণা করা হয় যে ১৫ শতকের শেষ দিক থেকে চোখ বাঁধা থেমিস বা জাস্টিসিয়ার মূর্তি নির্মিত হতে থাকে। তারপর থেকে চোখ বাঁধাই নিয়ম হয়ে দাঁড়ায় এবং বর্তমানে মুসলিম বিশ^ ছাড়া ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও এশিয়ার বিভিন্ন শহরে আদালত প্রাঙ্গণে লেডি জাস্টিসের চোখ বাঁধা মূর্তি স্থাপিত আছে। কাজেই এটি স্পষ্ট যে লেডি জাস্টিস মূলত গ্রিক দেবী থেমিসের বা রোমান দেবী জাস্টিসিয়ারই মূর্তি। কারণ এই মূর্তি নির্মাণ করা হয়েছে রোমান দেবী জাস্টিসিয়ার মূর্তিরই অনুরূপে। কাজেই একে নিছক মূর্তি বলার কোন সুযোগ নেই। ঐতিহাসিকভাবে এটি থেমিস দেবীরই মূর্তিÑ প্রাচীন রোমান মুদ্রায় অংকিত বিচারের দেবী জাস্টিসিয়ার (যা থেমিসেরই অনুরূপ) ছবি থেকেই তাকে মূর্তিরূপ দেয়া হয়েছে। অতএব লেডি জাস্টিসের মূর্তিকে ভাস্কর্য বা স্কাল্পচার নামে আখ্যায়িত করলেই দেবীমূর্তির কদর্যতা দূর হয়ে যাবে না।

মূর্তি, ভাস্কর্য, স্কাল্পচার এবং ধর্ম : এটর্নি জেনারেল সাহেব বলেছেন যে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে স্থাপিত মূর্তিটি মূর্তি নয়, স্কাল্পচার। ত্রিমাত্রিক যে কোন বস্তুর অবয়ব দানই হচ্ছে মূর্তি বা ভাস্কর্য। যে কোন বস্তু, উদ্ভিদ, প্রাণী বা মানুষের মূর্তি বা ভাস্কর্য নির্মিত হতে পারে। এমনকি কাল্পনিক কোন দেবতা বা দেবীর মূর্তি সর্বযুগেই পৌত্তলিক জাতিসমূহ নির্মাণ করে আসছে। আজও করছে। আর সে মূর্তি যখন শিল্পসম্মত উপায়ে বানানো হয় তখন তাই হয়ে যায় স্কাল্পচার বা ভাস্কর্য। ভাস্কর্য আর মূর্তির মধ্যে আভিধানিকভাবে কোন ব্যবধান নেই। একই জিনিসের দুটো নাম। কাজেই স্কাল্পচারের কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা রাষ্ট্রীয় উচ্চস্তরের দায়িত্বে থেকে কোন ক্রমেই বাঞ্চিত ও কাম্য নয়।

প্রাথমিককালের বৌদ্ধ ধর্মে, খ্রিস্টান ধর্মে কোন মানবীয় মূর্তি বা ভাস্কর্য গৃহীত হয়নি। অবশ্য পরবর্তীতে তা গৃহীত ও চালু হয়েছে। যদিও ইস্টার্ন অর্থডক্স চার্চ কোন ধরনের মূর্তি বা ভাস্কর্যকে মেনে নেয়নি। ১৯ শতকের পূর্ব পর্যন্ত ইহুদী ধর্মে ও সমাজে কোন মূর্তি বা ভাস্কর্য স্বীকৃত হয়নি। ইসলাম সদাসর্বদাই যে কোন প্রাণীর বিশেষত মানুষের মূর্তি বা ভাস্কর্যের বিরোধিতা করে আসছে। ইসলামে কোন মূর্তি কখনই স্বীকৃতি লাভ করেনি।

কোন বিষয়ের প্রতীকীরূপ ক্ষেত্র বিশেষে ইসলামও স্বীকার করে। উদারহণস্বরূপ দাঁড়িপাল্লা ন্যায়বিচারের প্রতীক এবং এটি দেখাবার ও বুঝাবার জন্য দাঁড়িপাল্লার ছবি বা ভাস্কর্য তৈরি কোন দোষাবহ নয়। কোন বস্তু বা উদ্ভিদের ছবি বা ভাস্কর্য নির্মাণ ইসলাম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেনি। শুধু প্রাণীর বিশেষত মানুষের ভাস্কর্য নির্মাণ ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে। আরো বিশেষভাবে কাকেও দেবতা বা দেবী কল্পনা করে অথবা দেবতা বা দেবী বলে পরিচিত কারো মূর্তি নির্মাণকে অত্যন্ত কঠোর ভাষায় নিষিদ্ধ করেছে। এসব কর্মকা- মূলত শিরক্ বা ¯্রষ্টার সঙ্গে শরিকানা বুঝায় যা অমার্জনীয় অপরাধ বলে বিবেচিত।

বস্তুত ইসলাম শিল্পকর্ম স্বীকার করে। ভাস্কর্যও ইসলামে স্বীকৃত। তবে সবকিছুর নয়। সমস্ত বস্তু ও উদ্ভিদের ছবি বা ভাস্কর্য নির্মাণে ইসলামে কোন বাধা নেই। ইসলাম শুধু আপত্তি করেছে কোন প্রাণীর বিশেষত মানুষের ভাস্কর্য নির্মাণের ক্ষেত্রে। মানুষের অবয়বে কোন দেবতা বা দেবীর মূর্তি নির্মাণ সবচেয়ে ঘৃণ্য কর্ম। কোন মুসলমান তা করতে পারে না। ভাস্কর্য হচ্ছে কোন কিছুর ত্রিমাত্রিকরূপ। কাজেই ভাস্কর্যের কথা বলে মূর্তি তৈরিকে বৈধ করার কোন সুযোগ নেই। শৈল্পিক মূর্তিই হচ্ছে আধুনিককালের ভাস্কর্য। ভাস্কর্য আর মূর্তি একই জিনিস। এর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। পার্থক্য শুধু শৈল্পিক মাত্রার। মূর্তি যেনতেনভাবে করা গেলেও ভাস্কর্যকে শিল্পগুণ সম্পন্ন হতে হয়। শৈল্পিকগুণ সম্পন্ন মূর্তিই ভাস্কর্য। কাজেই ভাস্কর্য বা স্কাল্পচারের কথা বলে মূর্তির বৈধতা দেয়া সম্ভব নয়।

মূর্তি সংস্কৃতি ও আমাদের সমাজ : আমাদের দেশের সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে অতি সম্প্রতি গ্রিক দেবী থেমিসের মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। এই উপমহাদেশে এটাই হচ্ছে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে স্থাপিত প্রথম মূর্তি, গ্রিক-রোমান দেবী মূর্তি। ভারত, নেপালের মতো পৌত্তলিক ধর্মের দেশেও এ ধরনের কোন মূর্তি স্থাপন করা হয়নি। শ্রীলংকা ও মায়ানমারেও করা হয়নি। করা হয়েছে আমাদের দেশে। শতকরা ৯০ ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত দেশে। কী প্রয়োজন সৃষ্টি হয়েছিল এ দেবী মূর্তি নির্মাণের? কেউ কি কখনও এর জন্য দাবী জানিয়েছিল? এটি কোন সাধারণ মূর্তি নয়Ñ এটি দেবী মূর্তি। স্থাপন করা হয়েছে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রবেশ মুখে। উদ্দেশ্য কি? আমরা জানি না এ মূর্তি নির্মাণের সিদ্ধান্ত কারা নিয়েছেন, কেন নিয়েছেন? এতদিন ধরে যে আদালতে এ মূর্তি ছিল না তখনকি ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছিল যা দেবী মূর্তি স্থাপন করে দূর করা হলো? আমরা এর কোন উত্তরই জানি না। যারা এর নির্মাণের পরিকল্পনা করেছেন, সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ব্যবস্থাপনা করেছেন তারাই ভালো বলতে পারবেন।

আমরা সবাই জানি যে এই আদালত প্রাঙ্গণের পাশেই রয়েছে জাতীয় ঈদগাহ। সেখানে বছরের দুইবার দেশের অন্যতম বৃহত্তম ঈদের জামাত হয়। সেখানে দেশের রাষ্ট্রপতিসহ লক্ষ লক্ষ মানুষ কয়েক জামাতে নামাজ পড়েন। নামাজিদের কাতারের উত্তর প্রান্তে এ মূর্তি নির্মাণ করা হয়েছে। নামাজিরা ডান দিকে সালাম ফিরালেই এ মূর্তি চোখে পড়বে। তাহলে কি দাঁড়ালো? দেবীর প্রতি সম্মান আদায়ের সূক্ষ্ম কৌশল? ইসলাম যেখানে রাষ্ট্রধর্ম সেই দেশে কি এমনটা কল্পনা করা যায়? আমাদের দুর্ভাগ্য যে রাষ্ট্রের উচ্চস্তর থেকে ইসলাম ও শির্কের মিশাল দেয়ার চেষ্টার আভাস মিলে। সরকার কি এর দায় এড়াতে পারবে? সরকার যদি এ ব্যাপারে অবহিত না থেকে থাকে তাহলে কারা এটা করেছে, কেন করেছে এটা তদন্ত করে দেখা প্রয়োজন। জনমনে প্রশ্ন ও বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি করে বর্তমান সরকারকে বিব্রত করার সূক্ষ্ম পরিকল্পনা কি না তাও ভেবে দেখতে হবে।

বাংলাদেশ প্রধানত তৌহিদবাদী মানুষের আবাসভূমি। তাই ইসলামে কোন বিচারেই মূর্তির স্থান নেই। আবার তা যদি হয় সর্বোচ্চ বিচারালয়ের সামনে দেবীমূর্তি স্থাপন! তাহলেও এটি রীতিমত তৌহিদবাদী ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। কিছু বুদ্ধিজীবী নামধারী লোক সবকিছুতেই পশ্চিমের অনুকরণ করাকে পছন্দ করেন। তারা মূর্তিকে নাম দিয়েছেন ভাস্কর্য। প্রশ্ন হলো যে, ভাস্কর্য নাম দিলেই কি মূর্তি বা দেবী মূর্তি গ্রহণযোগ্য হয়ে যায়? কিছুলোকের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে। কিন্তু দেশের অধিকাংশ মানুষের নিকট তা গ্রহণযোগ্য নয়। ইহুদী ও খ্রিস্টান ধর্ম প্রথম দিকে সমস্ত মূর্তির বিরুদ্ধে ছিল। পরে গ্রিক-রোমান পৌত্তলিক সংস্কৃতি ও ঐতিয্যের প্রভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে ধীরে ধীরে ভাস্কর্য নাম দিয়ে দেবীমূর্তি ও সাধারণভাবে সবধরনের মূর্তিকে মেনে নেয়। বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে তা স্থাপিত হতে থাকে। তাদের দেখাদেখি মুসলিম নামধারী কিছু পাশ্চাত্যের দাসানুদাস শ্রেণীর মানুষ মূর্তিপ্রেমিক হয়ে পড়ে। তারা সুযোগ পেলেই মুসলিম দেশে তা আমদানী করতে সচেষ্ট হয়। যদিও মুসলিম দেশগলোতে পশ্চিমাপ্রেমিকরা এসব মূর্তিপ্রেম খুব একটা কার্যকর করতে পারে না। মাঝে মাঝে কিছু কিছু স্বৈরশাসক ঐসব বিকৃত বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শে মূর্তি স্থাপনের ঘৃণ্য কাজে লিপ্ত হয়। বিশেষ করে ১৯৪৬ সালে ইরানের কুখ্যাত শাহ প্রথমবারের মতো সুপ্রিম কোর্টের সামনে পাশ্চাত্যের অনুকরণে গ্রিক বিচারের দেবী থেমিসের মূর্তি স্থাপন করেছিল। একমাত্র এ উদাহরণটি বাদে এ পর্যন্ত মুসলিম দেশের শাসকরা যত মন্দই হোক না কেন আদালতের সামনে দেবীমূর্তি স্থাপনের মতো চরম ইসলাম বিরোধী কর্মটি করেননি বা করতে সাহস পাননি। কিন্তু আজ আমাদের দেশে কী কারণে সুপ্রিম কোর্টের সামনে লেডিস জাস্টিসের নামে দেবী মূর্তি স্থাপনের প্রয়োজন দেখা দিলো? যারা পরিকল্পনা করেছেন, যারা নির্মাণের ব্যবস্থাপনা করেছেন তারাই এর ভালো জবাব দিতে পারবেন। তবে কাজটি যে ধর্মীয়ভাবে, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে সংগত হয়নি তাতো সুস্পষ্ট। কর্তৃপক্ষ যত তাড়াতাড়ি ব্যাপারটি অনুধাবন করবেন ততই ভালো।


লেখক : মহাসচিব, খেলাফত মজলিস