ড. আহমদ আবদুল কাদের
মহাসচিব, খেলাফত মজলিস


গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটেছে। সুদীর্ঘ ১৬টি বছর গজাতির জাতির ঘাড়ে চেপে বসেছিলো এক ভয়াবহ ফ্যাসিবাদ। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ফ্যাসিবাদী হাসিনা তার প্রভুর দেশ ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। ছাত্র জনতার আন্দোলনে প্রায় দেড় হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে। প্রায় বাইশ হাজার মানুষকে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে এত স্বল্প সময়ের ব্যবধানে দীর্ঘদিন স্থায়ী হওয়া স্বৈরতন্ত্রের পতন হওয়ার ঘটনা খুব একটা নেই। এই প্রায় অসম্ভব ঘটনাটি ঘটেছে প্রায় দেড় হাজার মানুষের আত্মদান ও প্রায় বাইশ হাজার মানুষের পঙ্গুত্ব বরণের বিনিময়ে। এর মাধ্যমে জাতি দ্বিতীয়বার মুক্তি লাভ করেছে। এ মুক্তি জাতীয় জীবনে অনেক প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছে। এই প্রত্যাশার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- মানবতাবিরোধী ও গণহত্যাকারী খুনী হাসিনা ও তার দোসরদের দ্রুত বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা করা।

দেশের ধ্বংসপ্রায় বিচার বিভাগ, পুলিশ বিভাগ, প্রশাসনিক বিভাগ, অর্থ ও ব্যাংকিং বিভাগ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিভাগসহ সকল বিভাগকে দ্রুত সংস্কারের আওতায় এনে মানুষের কল্যাণে জনবান্ধব কর্মক্ষম ও শক্তিশালী করে গড়ে তোলা। দেশের আইন সভা-জাতীয় সংসদ, বিচার বিভাগ যেন স্বাধীনভাবে ও প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সমন্বয় করে স্বার্থক ও সুন্দরভাবে চলতে পারে তার ব্যবস্থা করা।

ভারতের সেবাদাস পতিত হাসিনা সরকারের সাথে ভারতের সাথে সম্পাদিত সকল চুক্তির পূর্ণমূল্যায়ণ এবং দেশের স্বার্থবিরোধী চুক্তি বাতিল ও ক্ষেত্র বিশেষে চুক্তির ধারা সংশোধন করতে হবে। বিডিআর হত্যাকাণ্ডের অপ্রকাশিত তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ, প্রয়োজনে নতুন তদন্ত কমিশন গঠন এবং প্রকৃত দায়ীদের সনাক্ত করে দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে। একইসাথে শাপলা চত্বর হত্যাকাণ্ড, সাগর- রুনি হত্যা, ‘আয়না ঘর’ কাণ্ডসহ সকল গুম ও খুনের যথাযথ বিচার করতে হবে।

দ্রুত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে দ্রব্যমূল্য কমানো, বাজার সিন্ডিকেটকে দ্রুত অপসারণ, অসাধু ব্যবসায়ীদের শাস্তি বিধানসহ কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকা হাসিনার দোসরদের অতিসত্তর বরখাস্ত করতে হবে।

হাসিনার নিয়োগকৃত দুর্নীতিবাজ ও মিথ্যাচারে লিপ্ত রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করে সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করা। আন্দোলনে নিহত ব্যক্তিদের ‘জাতীয় বীর’ ঘোষণা করা এবং আহতদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা। এই প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আশু সংস্কারের বিষয়ে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া। যেতে পারে।

সরকার ব্যবস্থার সংস্কার : দেশের বর্তমান ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীকে যে ব্যাপক ক্ষমতা ও স্বেচ্ছাচারী হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে তা দূরীকরণে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য বিধান করতে হবে। একই সাথে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি কেউই যেন একাদিক্রমে দুই মেয়াদের বেশি স্বপদে থাকতে না পারেন তার ব্যবস্থা করা।

নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও নির্বাচনীব্যবস্থা সংস্কার : অবিলম্বে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে দ্রুত এগিয়ে নেয়ার কার্যকর ব্যবস্থা করতে হবে। একই সাথে দলনিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা চালু করতে হবে। দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট ব্যবস্থা চালু করা। নিম্নকক্ষের আসন সংখ্যা ৫০০-তে উন্নীত করা। উচ্চকক্ষে ১০০ জন সদস্য রাখার ব্যবস্থা করা। সৎ ও যোগ্য প্রার্থীরা যাতে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে পারে সেজন্য নির্বাচনী ব্যয় কমানো, নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে প্রার্থীদের নির্বাচনী সভার আয়োজন করা এবং অর্থ ও পেশী-শক্তির দাপট নিবারণসহ সকল অব্যবস্থা দূর কর করতে হবে। তাছাড়া সরকারি দল থেকে স্পিকার ও বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন করতে হবে।

স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার সংস্কার : স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে তাকে স্থানীয় উন্নয়ণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন বিভাগ স্থানীয় সরকারের অধীনে দিতে হবে। সংসদ সদস্যগণ যাতে দেশের আইন ও পলিসি প্রণয়নের কাজে ব্যস্ত থাকেন এবং স্থানীয় সরকারের কাজে কোন রূপ হস্তক্ষেপ না করেন তার কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

প্রশাসনিক সংস্কার : সীমাহীন দলীয়করণের মাধ্যমে প্রশাসনের সর্বস্তরে স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার যে ক্ষত সৃষ্টি করে গেছে তা দ্রুত দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার করে জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনসহ সর্বত্র সুষ্ঠু নিয়ম-নীতি প্রতিষ্ঠা ও শৃঙ্খলা বিধান নিশ্চিত করতে হবে যাতে প্রশাসন ক্ষমতাসীন দলের লেজুড় বৃত্তির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।

অর্থ ও ব্যাংক ব্যবস্থা সংস্কার : দুর্নীতিবাজ মাফিয়া হাসিনা সরকার দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি ও ব্যাংক ব্যবস্থায় যে সীমাহীন দুর্নীতি, বিশৃঙ্খলা ও দূরাবস্থা সৃষ্টি করেছে দ্রুত আর্থিক সংস্কার করে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা এবং ইতিবাচক ও আস্থার পরিবেশ দ্রুত ফিরিয়ে আনতে হবে। দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রণয়নে গঠিত জাতীয় কমিটি যাতে দ্রুত তা প্রণয়ন ও প্রকাশ করে তার ব্যবস্থা করতে হবে। দুর্নীতিগ্রস্থ ব্যক্তিদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করতে হবে।

শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কার : দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাস ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে মান সম্পন্ন নৈতিক, কারিগরি ও তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর যুগোপযোগী শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য যোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে শিক্ষা কমিশন গঠন, নতুন শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন ও প্রবর্তন করতে হবে। চলমান শিক্ষানীতি ও শিক্ষাক্রম বাতিল করতে হবে।

আইনি সংস্কার : ব্যাপকভাবে সমালোচিত বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিল, আইসিটি ও ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট সংশোধন এবং অনাস্থা প্রস্তাব ও বাজেট প্রস্তাব পাশের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

ইতিমধ্যেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন, সংবিধান সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন, নির্বাচন সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করা হয়েছে। তাছাড়া শিক্ষা সংস্কারের জন্য একটি কমিটি, অতীতে দুর্নীতির অনুসন্ধান ও একটি শ্বেতপত্র প্রকাশের জন্য একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য একটি সার্স কমিটিও ঘোষণা করা হয়েছে। এসব কমিশন ও কমিটি গঠন অবশ্যই ইতিবাচক। তবে সেগুলোর কার্যক্রম দ্রুত হওয়া প্রয়োজন। তারা সুপারিশমালা পেশ করার জন্য যে তিনমাস সময় দেয়া হয়েছে এই সময়ের মধ্যেই সুপারিশমালা তৈরি করা জরুরি। আর্থিক ও ব্যাংক খাতের সংস্কারের জন্য এখনও কোনো কমিশন গঠন করা হয়নি। এখন পর্যন্ত শ্রম বিষয়ক কোন কমিশন গঠন করা হয়নি। শিক্ষা কমিশনও গঠন করা হয়নি। এসব বিষয়ে কমিশন গঠন করা অত্যাবশ্যক। আমাদের দাবি হচ্ছে দ্রুততার সাথে কমিশনগুলোর কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। দ্রুত সুপারিশমালা প্রণয়ন করা। কমিশনের কাজ শুরুর প্রারম্ভেই রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করা ও তাদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ নেওয়া। এতে মতপার্থক্য কমে আসবে। অন্যথায় সুপারিশ তৈরি করে বসতে গেলে মতপার্থক্য বেড়ে যাওয়ার আশংকাই বেশি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে যেসব বিষয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সবশেষ নজর দিতে হবে তা হচ্ছে- দ্রব্যমূল্য কমানোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

দীর্ঘদিন ধরে গড়ে বাজার সিন্ডিকেট বিলুপ্ত করতে হবে।অসাধু ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। বাজার মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। পতিত হাসিনা ও তার দোসরদের দ্রুত গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। সাথে সাথে নির্দোষ কোন ব্যক্তি যেন কোন হয়রানির শিকার না হয় তার দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। আন্দোলনে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার ব্যাপারে এখনও অনেক অভিযোগ শুনা যায়। বর্তমান সরকারকে আহতদের চিকিৎসার সমস্ত ব্যয়ভার বহন করতে হবে। আহতদের অভিভাবকগণ যে অভিযোগ করছেন তা আমলে নিয়ে তার বিহীত ব্যবস্থা করতে হবে। আন্দোলনের শহীদদের ‘জাতীয় বীর’ ঘোষণার বিষয়টি এখনও সরকার আমলে নেয়নি। অতিসত্ত্বর তা আমলে নিয়ে তা কার্যকর করতে হবে। শ্রমিকদের ন্যায় সংগত দাবি-দাওয়া পূরণ করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। ফ্যাসিবাদের সহযোগী সমস্ত পুলিশকে বরখাস্ত করতে হবে এবং অতিদ্রুত নতুন পুলিশ নিয়োগ করতে হবে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ণের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটি রোড ম্যাপ ঘোষণা করতে হবে।

সর্বশেষ, ছাত্র জনতার দাবির পরিপেক্ষিতেই বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। তাই সে সরকারকে সহযোগিতা করা সবারই কর্তব্য। আর সরকারকেও তার দায়িত্ব পালনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে হবে, হতে হবে সচেতন ও কর্মদক্ষ। ছাত্র জনতার আকাঙ্খাকে আমলে নিয়ে যথাবিহীত পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ, এ সরকার অকৃতকার্য হলে গণঅভ্যুত্থানের লক্ষ্যই ভন্ডুল হয়ে যাবে। তাই এ সরকার যাতে সফল হতে পারে তার জন্য প্রতিটি দেশ প্রেমিক মানুষকে সহযোগিতা করতে হবে। এ সরকার সফল হোক এই কামনাই করছি। মহান আল্লাহ এ সরকার ও জাতিকে সাহায্য করুন। আমিন।


জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের ৯০ দিন উপলক্ষ্যে দৈনিক খোলা কাগজের বিশেষ আয়োজন ‘অভিভাষণ’-এ প্রকাশিত।