অধ্যাপক আবদুল্লাহ ফরিদ
নায়েবে আমীর, খেলাফত মজলিস


ভূমিকা : ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে ঢাকার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে খেলাফত মজলিসের দ্বাদশ সাধারণ অধিবেশনকে কেন্দ্র করে যে বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়- জাতীয় প্রেক্ষাপটে ঐ মহাসমাবেশের মৌল স্লোগান ছিল ‘বিভেদ নয় ঐক্য, কল্যাণমূলক রাষ্ট্র’। সংগঠনের পাশাপাশি জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃৃবৃন্দ সেখানে উপস্থিত হয়ে জাতীর উদ্দেশ্যে যে দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্য রেখেছিলেন তারই ধারাবাহিকতায় আজকের ‘‘বৈষম্যমুক্ত কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় জাতীয় ঐক্যের গুরুত্ব’’ শীর্ষক আলোচনা সভা। এতে উপস্থিত সবাইকে সালাম ও আন্তরিক মোবারকবাদ।

বৈষম্যমুক্ত সমাজ ও কল্যাণ রাষ্ট্রের সংক্ষিপ্ত ধারণা
বৈষম্যমুক্ত সমাজ বলতে সেই সমাজকে বুঝায় যেখানে রাষ্ট্র মানুষের মাঝে বৈষম্য সৃষ্টি করে না। এরূপ সমাজে লিঙ্গ, বর্ণ, ধর্ম, গোত্র, সম্প্রদায়, অঞ্চল, অবস্থান, শারীরিক আর্কষণ এবং সক্ষমতার ভিত্তিতে মানুষকে কোনো বৈষম্যের শিকার হতে হয় না। কল্যাণ রাষ্ট্র মূলত এরূপ সমাজ প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট থাকে। যে রাষ্ট্র জনগণের মৌলিক অধিকার; যেমন- খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা, নিরাপত্তা ইত্যাদি পূরণে সচেষ্ট এবং অক্ষম ও অসহায়দের সার্বিক সহায়তা করতে যত্নবান তাকে কল্যাণ রাষ্ট্র বলে। আইনের শাসন, সামাজিক সুবিচার, জনগণের জানমালের সুরক্ষা, মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন- এরূপ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্র্ণ বৈশিষ্ট্য। ‘দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন’ রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূলমন্ত্র। জনগণ, প্রতিষ্ঠান ও দল সবার মধ্যে পারষ্পরিক সহমর্মীতা, শ্রদ্ধাবোধ, কল্যাণ চিন্তা, উন্নত মন-মানসিকতা এবং রাষ্ট্রের প্রতি গভীর অনুরাগ ও ভালোবাসা এরূপ রাষ্ট্রের শক্তির অন্তর্নিহিত উৎস।

রাষ্ট্র পরিচালনায় নিয়োজিত সকলেই এরূপ রাষ্ট্রে ক্ষমতাকে দায়িত্ব বলে গণ্য করে এবং জনগণের সেবক হিসেবে জবাবদিহিতার মানসিকতা নিয়ে সেই দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকে। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে রাষ্ট্র ও জনগণ- সবার মধ্যে দৃঢ় অঙ্গীকার ও মনোভাব এবং জাতির বিভিন্ন মৌলিক ইস্যুতে সকল দল ও মানুষের অভিন্ন উপলদ্ধি ও ঐক্যবদ্ধ চেতনা কল্যাণ রাষ্ট্রের টিকে থাকার সামর্থ্য (Sustainability) কে দৃঢ় ভিত্তি প্রদান করে।

সর্বোপরি একটা কল্যাণ রাষ্ট্রে সরকার এবং জনগণের মধ্যে ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্র্থ সর্বোচ্চ প্রাধান্য পায় না। জাতীয় স্বার্থ এবং সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষের বৈষম্যমুক্ত কল্যাণ- সেখানে গুরুত্ব লাভ করে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, দল ও রাষ্ট্র একটা অভিন্ন আদর্শিক অনুপ্রেরণায় সামনের দিকে এগিয়ে চলে। উত্তরোত্তর জাতীয় অথনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিকসহ সকল স্তরে ইতিবাচক অগ্রগতি মানুষকে পশ্চাদপদ মানসিকতা থেকে বের করে উন্নত ভবিষ্যতের প্রেরণায় সামনের দিকে এগিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করে।

উপরোক্ত বিচারে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়াস লক্ষণীয় এবং যা এখনও চলমান। তবে সম্পূর্ণ কল্যাণ রাষ্ট্র সম্পর্কে যদি ধারণা নিতে হয় তবে ১৪০০ বছর পূর্বে নবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) ও সম্মানিত খলিফাগণের প্রতিষ্ঠিত খিলাফত তথা কল্যাণ রাষ্ট্র ব্যবস্থার দিকে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। যেখানে মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানেই যাকাত নেয়ার জন্য মানুষ খুঁজতে হয়েছে। সকল অসহায়, পঙ্গু ও এতিমদের দায়িত্ব নিয়েছে রাষ্ট্র। হযরত ওমর (রাঃ) বলেছেন, ফোরাতের কূলে একটা কুকুরও যদি না খেয়ে মরে তার দায়িত্ব খলিফাকে বহন করতে হবে। সে সময়ে ন্যায় বিচার, ইনসাফ ও নাগরিক নিরাপত্তার যে বাস্তব নমুনা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা ভাবতেও অবাক লাগে।

উল্লেখ্য, একজন সাধারণ বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে যদি তার ‘প্রত্যাশিত রাষ্ট্র’ এর ধারণা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় তবে সে যা যা বলবে তা থেকে একটা কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা ও প্রত্যাশারই প্রমাণ মিলবে। কিন্তু কল্যাণমূলক রাষ্ট্র রাতারাতি প্রতিষ্ঠার মতো কোনো বিষয় নয়।

যোগ্য নেতৃত্বের ওপর কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টি নির্ভরশীল
একটা হতাশাব্যঞ্জক অবস্থা বা যুদ্ধ-বিগ্রহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গড়ে উঠা তীব্র জন-আকাঙ্খায় সাধারণভাবে এরূপ রাষ্ট্র বিকশিত হয়। যোগ্য নেতৃত্ব যখন এরূপ আকাঙ্খার বাস্তবায়নে এগিয়ে আসে এবং ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থ বিবেচনার উর্দ্ধে উঠে দেশ ও দশের কল্যাণে নিজেদের উৎসর্গ করার মানসে এগিয়ে যায় তখন উক্ত নেতৃত্বকে ঘিরে ঐক্যবদ্ধ জাতি বৈষম্যমুক্ত কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রসর হয়।

আর নেতৃত্ব সেই সুযোগকে যদি ব্যক্তিক ও দলীয় স্বার্থে কাজে লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং সবাইকে সাথে নিয়ে চলার বিপরীতে জনগণকে বিভক্ত করে তবে নিশ্চিতভাবেই সমাজে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও দলের মধ্যে বিভক্তি বৃদ্ধি পায়। এর সুযোগ নেয় সরকারি-বেসরকারি সুবিধাবাদী টাউট শ্রেণি। সরকার ধীরে ধীরে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। যার চুড়ান্ত রূপ জাতি হিসাবে আমরা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছি। আমরা দেখেছি, আধিপত্যবাদী বিদেশি শক্তি এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জনআকাঙ্খাকে ধুলায় মিশিয়ে দেয়।

প্রায় দু’শ বছরের বৃটিশ অপশাসনের পর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ও ভারত দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পিছনে ছিল এক সুদীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। মুসলিম লীগ স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিলেও স্বাধীনতা অর্জনের পর আমরা লক্ষ করেছি, জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনের গুরুত্বপূর্ণ এ অধ্যায়ে তারা সফল হয়নি। নেতৃবৃন্দ একে অন্যকে সন্দেহ করেছে, ষড়যন্ত্র করেছে। আন্দোলনের সহযোগী সংগঠনগুলোও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেনি। ফলে স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা জনগণের ঐক্য বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিবাদ ও ক্ষমতার রশি টানাটানিতে তখন সামরিক শাসনের পথ সুগম হয়। পরবর্তী সময়ে আঞ্চলিক বৈষম্যের বিরদ্ধে, গণতন্ত্রের দাবিতে এবং উন্নত, সমৃদ্ধশালী ও কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ার মানসে এই ভূখন্ডের মানুষ ইস্পাত কঠিন ঐক্য নিয়ে ১৯৭১ এ রাস্তায় নেমে আসে । নয় মাসের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ, কঠিন আত্নত্যাগ ও লাখো শহীদের জীবনের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, স্বাধীনতা লাভের পরই তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার দেশকে ঐক্যবদ্ধ না করে বিভক্তির দিকে ঠেলে দেয়। জাতীয় সরকার গঠন না করে দেশকে একান্তভাবেই তাদের দলীয় ও পরবর্তীতে একক পরিবারের সম্পদে পরিণত করার মারাত্মক বিপর্যয়কর দূরভিসন্ধিতে লিপ্ত হয়ে পড়ে। ‘বিশ্বে এলো নতুন বাদ, মুজিববাদ’ -এ স্লোগান কার্যকর করার ষড়যন্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে মুক্তি বাহিনীর বিপক্ষে মুজিব বাহিনী গড়ার মধ্য দিয়েই প্রকাশ পেয়েছিল, যা সদ্য স্বাধীন দেশে বাস্তবায়নে তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করে। শত শত মুক্তিযোদ্ধা ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিনা বিচারে হত্যা করা হয়। লুটপাট ও দুর্নীতির মচ্ছব চালায়। দেশকে তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত করে। পরে বাকশাল গঠন করে জন আকাঙ্খার শেষ কফিনেও পেরেক গেড়ে দেয়। যার দূর্ভাগ্যজনক অথচ অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট নিহত হতে হয় এ অধ্যায়ের মুখ্য কুশীলবদের।

১৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের পর জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে কাজ শুরু হলেও সেটা ছিল খুবই দূরুহ। তৎকালীন সরকার বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনরায় চালু করে যে শুভ সূচনা করেছিলেন যার পরিণতিতে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতিসহ সবক্ষেত্রে একটা ইতিবাচক ধারা পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু ষড়যন্ত্রমূলক ক্যু-এর মাধ্যমে রাষ্ট্র প্রধানকে শহীদ করার পর আবার ষড়যন্ত্র, ভাওতাবাজি ও বিভেদের রাজনীতি ফিরে আসে। বাধাগ্রস্ত হয় কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়াস।

এরশাদ বিরোধী ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ১৯৯১ এ গণতন্ত্রের নতুন অভিযাত্রা শুরু হয়। ঐক্যমতের ভিত্তিতে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরে গেলে দায়িত্বশীল বিরোধী দলের ভূমিকা পালন না করে তারা জাতিকে বিভিক্ত করার কুটষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। নতুন নির্বাচিত সরকারকে এক মূহুর্তও শান্তিতে থাকতে না দেয়ার ঘোষণা দিয়ে বিরোধী নেত্রী জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার আবশ্যকীয় প্রয়াসকে সুদূর পরাহত করে তোলে।

কেয়ারটেকার সরকার ইস্যুতে বিভেদ ও বিভক্তি নতুন মাত্রা পায় এবং এক পর্যায়ে রাজনীতিকরা একমত হয়ে এরূপ সরকার প্রতিষ্ঠা করেন বটে কিন্ত বিভেদের ধারা বজায় থাকে। পরবর্তী দু’টি নির্বাচন জন আকাঙ্খার সাথে কিছুটা সংগতিপূর্ণ হলেও জাতীয় স্বার্থে সব দলের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন-আকাঙ্খা পালিত হয়নি। পরবর্তীতে মঈনুদ্দীন ও ফখরুদ্দীনের সরকার দেশীয় ও আর্ন্তজাতিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ফ্যাসিষ্ট হাসিনাকে ক্ষমতায় বসায়।

এরপরের ১৬ বছরের ইতিহাস একটা স্বাধীন দেশ ও জাতি সত্ত্বাকে ধ্বংশ করার অব্যাহত ষড়যন্ত্রের ইতিহাস, দেশের সকল প্রতিষ্ঠান ও ব্যবস্থাকে সচেতনভাবে ধ্বংশ করার ইতিহাস, অব্যাহত গুম, খুন, হামলা, মামলা ও ভীতি সৃষ্টির মাধ্যমে ক্ষমতার অবৈধ মসনদকে পাকাপোক্ত করার ইতিহাস এবং নানান কায়দায় রাষ্ট্রের সম্পদ পাচার করে দেশকে ফোকলা করার ইতিহাস।

ফ্যাসিষ্ট হাসিনা সরকারের পতন এবং জন-আকাঙ্খার নতুন বাংলাদেশ
মহান রাব্বুল আলামিনের অপার অনুগ্রহে ৫ আগস্ট ২০২৪ এ ফ্যাসিস্ট হাসিনা তার সকল বশংবদ নিয়ে দেশ ছেড়ে পলায়ন করে। আপামর ছাত্র জনতা এবং সকল দল ও মতের আকুন্ঠ সমর্থনে ডাঃ মোঃ ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। এ সময়ে সবকিছু এমন দ্রুততার সাথে ঘটেছে যে, তা ভাবতেও অবাক লাগে। জুলাই বিপ্লবে ছাত্র জনতার তুমুল আন্দোলনে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ব্যাপক জান-মালের ক্ষতিসাধন ঘটে। ৫ আগস্ট ২০২৪ এর সকালেও কেউ বিশ্বাস করতে পারেনি দুপুরে কি ঘটবে। জগদ্দল পাথর এভাবে সরে যাবে তা যেন ছিল জাতির সামনে একটা বিস্ময়। তাই পরবর্তীতে কি হবে, কেমনে দেশ চলবে, কি পরিস্থিতি ঘটতে পারে এবং ঘটলে তা কিভাবে মোকাবেলা করা হবে -এগুলো কার্যত কারও ভাবনাতেই আসেনি। তবে এ গণআন্দোলনে ছাত্র-জনতার ব্যাপক সম্পৃক্ততার পিছনে প্রত্যাশার মুখ্য বিষয়গুলো ছিল-

১. স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের যেন পতন ঘটে এবং জালেম সরকারের সকল অপকর্ম ও গুম-খুনের যেন বিচার হয়।
২. গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যেন বিকশিত হয় এবং স্বৈরাচারী ব্যবস্থা যেন কখনই আর ফিরে আসতে না পারে।
৩. বৈষম্যমুক্ত কল্যাণ রাষ্ট্র যেনো প্রতিষ্ঠিত হয় যাতে মানুষের জীবন মানের উত্তরোত্তর উন্নয়ন ঘটে এবং মানুষ সুখে-স্বছন্দে বসবাস করতে পারে।
৪. আইনের শাসন যেন দেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করে যেখানে দুর্নীতি, অন্যায়, জুলুম ও নির্যাতনের সকল পথ রুদ্ধ হয়।
৫. মেধা ও যোগ্যতা যেন সর্বত্র মূল্যায়িত হয় এবং স্বজনপ্রীতি, গোষ্ঠিপ্রীতি, অঞ্চলপ্রীতি ইত্যাদি যেন মূল্যায়নের মাপকাঠি হতে না পারে।
৬. দেশের অর্থ ও ব্যাংক ব্যবস্থা, প্রশাসনিক ব্যবস্থা, নির্বাচনী ব্যবস্থাসহ প্রয়োজনীয় সকল ক্ষেত্রে সংস্কার ও উন্নয়ন যাতে নিশ্চিত হয়।
৭. স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যেনো মাথা উঁচু করে চলতে পারে।

বর্তমান সরকার ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এখন যে সকল প্রশ্নের সম্মুখীন 
এখন প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে আগস্ট বিপ্লবের শহীদদের আত্নত্যাগ এবং গণমানুষের স্বতঃফুর্ত জাগরণ কি ১৯৪৭, ১৯৭১ ও ১৯৯০ এর মতো পুনরায় হারিয়ে যাবে। পতিত স্বৈরাচারকে তাড়াতে স্কুলের সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা এবং সকল শ্রেণি- পেশার মানুষ যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল- অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দানকারী সম্মানিত ছাত্র সমন্বয়কবৃন্দ ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ভুলে তা কি হারিয়ে যাবে? নেতৃত্বের ভুলে কি আমরা আবার বিভেদ ও ষড়যন্ত্রের অতল গহবরে তলিয় যাবো? আগামী নেতৃত্ব কি আবার আধিপত্যবাদী শক্তির দোসরে পরিণত হবে? জন-আকাঙ্খা কি আবার হতাশার সাগরে নিমজ্জিত হবে? শহীদদের আত্মত্যাগ কি কোনই কাজে আসবে না? পুরনো স্বৈরাচার কি আবার ফিরে আসবে? উপরোক্ত সকল প্রশ্নের জবাব বর্তমান আসীন নেতৃত্ব এবং সকল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকেই দিতে হবে। নিজেদেরকে শুধরাতে হবে। আগের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে। জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে সবাইকে একসাথে নিয়ে চলার গতিপথ রচনার এখনই প্রকৃষ্ট সময়।

বিভেদের রাজনীতির দায় বর্তাবে রাজনীতিকদের ওপর
রাজনীতিবিদরা দেশের নেতৃত্ব দেবেন এটাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূলকথা। আগামীতে যারা নির্বাচনে ক্ষমতায় যাবেন এবং যারা বিরোধী দল হিসেবে বিরোধী চেয়ারে বসবেন তারা আওয়ামী আমলের প্রতিহিংসার ধারা থেকে বেরিয়ে দেশ ও জাতির উন্নয়নে ভূমিকা রাখবেন এটাই সকলের প্রত্যাশা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, জাতির সে জন-আকাঙ্খা পূরণে রাজনীতিক ও সংশ্লিষ্টরা কতটা সমর্থ হবেন তাদের কিছু বক্তব্য, বিবৃতি ও আচরণে ইতোমধ্যেই সেই সন্দেহ দেখা দিয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে পরিস্থিতি কতটা খারাপ ও বিপদজনক হতে পারে তার কিছুটা ধারণা নিম্নে তুলে ধরা হলো:

১. পতিত স্বৈরাচার বিদেশে পালিয়ে গেলেও এখনও সক্রিয়। তার সাঙ্গপাঙ্গ বড় কেউই কার্যত ধরা পড়েনি। পাশের দেশে বসে তারা অহোরাত্র দেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র আটছে।
২. দেশের মধ্যে পতিত সরকারের দলকানা নেতাকর্মীরা বর্তমানে অনেকটা চুপচাপ থাকেলেও এরুপ বিরোধ তাদেরকে উৎসাহী ও সাহসী করবে। ফলে জনগণের মধ্যে মিশে তারা বর্তমান সরকার ও বিপ্লবের বিরুদ্ধে সহজেই ঘৃণা ছড়াবে। কখনও একদলের সাথে মিশে অন্য দলের সাথে মারামারি বাঁধাবে।
৩. প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে ঘাপটি মেরে থাকা স্বৈরাচারের দোসরেরা রাজনীতিকদের মধ্যে বিরোধের সুযোগ নিয়ে সাহসী হবে ও ষড়যন্ত্র করতে উৎসাহিত হবে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া ও বাধাগ্রস্ত হবে।
৪. এরূপ বিরোধে আধিপত্যবাদী শক্তি উৎসাহিত হয়ে সরকারের ওপর নতুন নতুন চাপ সৃষ্টিতে উৎসাহিত হবে। প্রয়োজনে বিভিন্ন দলকে কিনে নেবে বা প্রভাব বৃদ্ধি করে নতুনভাবে ফিরে আসতে চাইবে।
৫. দেশের অভ্যন্তরে চোর, ডাকাত, চাঁদাবাজ, ঘুষখোর ও দেশবিরোধী শক্তি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাবে। যাতে সাধারণ জনগণ ধীরে ধীরে বিপ্লবের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে।

মনে হতে পারে দেশে সরকার আছে তাই দায় কেন রাজনীতিকদের ওপর বর্তাবে? কিন্তু বাস্তবতা হলো মানুষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কম দুষবে। বিগত সাড়ে পাঁচ মাসে এ সরকার কতকগুলো ক্ষেত্রে অনেকটা সফল হয়েছে; যেমন- অর্থ ও ব্যাংক ব্যবস্থার কিছুটা উন্নয়ন হয়েছে, অর্থ পাচার বন্ধ হয়েছে, উপরি পর্যায়ে দুর্নীতি কমেছে, বিচার ব্যবস্থা ও দুদকের কার্যক্রম আস্থা ফিরাচ্ছে। সংস্কার কমিশনগুলো রিপোর্ট জমা দিচ্ছে, সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় ভালো করছে। যদিও দ্রব্যমূল্য কমানো যাচ্ছে না, আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি, প্রশাসনিক স্থবিরতা কাটছে না ইত্যাদি মোটা দাগে সমস্যা বিদ্যমান। তবে এই সরকারের সফলতা রাজনৈতিক পরিবেশের ওপর অনকেটা নির্ভশীল। রাজনীতি খারাপ হলে এই সরকার ভালো করবে এটা কখনই প্রত্যাশা করা যায় না। জনগণও তা মনে করে না।

দেশের স্বার্থে যে সকল বিষয়ে একমত হওয়া ও ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা রাখা আশু প্রয়োজন
নিজেদের মধ্যে বিবাদ কমিয়ে একটা সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টিতে ঐক্যবদ্ধ কিছু প্রয়াস দেশের স্বার্থে এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্য কিছু মৌলিক বিষয়ে একমত হওয়া ও তা বাস্তবায়নে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা রাখা অত্যন্ত জরুরী। সেজন্য দেশপ্রেমিক সকল রাজনৈতিক দল, এর নেতত্ব ও অনুুসারীগণকে নিম্নোক্ত অনুরোধ করছি:

১. দলের ওপর দেশকে বড় করে দেখি। বিশ্বাস রাখি যে, দেশ বাঁচলে আমাদের রাজনীতি বাঁচবে এবং সুখী-সমৃদ্ধ কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ে উঠলে দেশের ইতিহাস আমাদের স্মরণে রাখবে। এখন বিবাদ করার সময় নয়।
২. সফল গণঅভ্যুত্থানে নিজস্ব কৃতিত্ব জাহির করার চেষ্টা পরিহার করি সকল দল ও আপামর ছাত্র-জনতা এবং সর্বোপরি মহান রাব্বুল আলামিনকে কৃতিত্ব দিই।
৩. অন্যকে আহত করে এমন কথা বলা থেকে বিরত থাকি। বিশেষভাবে দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দকে এ বিষয়ে অধিক সতর্ক হতে অনুরোধ জানাই। নিজ দলসহ অন্যদেরকেও এ বিষয়ে সতর্ক করি।
৪. আনুষ্ঠানিক আলোচনার বাইরেও নিজেদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক আলোচনাকে উৎসাহিত করি। যা তিক্ততা কমাতে ও সম্পর্ক বৃদ্ধিতে এবং আন্তঃদলীয় ঐকমত্য সৃষ্টিতে অধিক ভূমিকা রাখবে।
৫. কেউ কাউকে ছোট না ভাবি। কথা ও কাজে মিল রেখে চলি। সকল ক্ষেত্রে আন্তরিকতা ও সততা বজায় রাখি। রাজনীতিকে মিথ্যা বলা, শঠতা, প্রতারণা, ধোঁকা এবং পচা পুঁতিগন্ধময় অবস্থা থেকে বের করে আনি।
৬. ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার দোসরদের সংঘটিত সকল অপকর্মের দ্রুত বিচারে সরকারকে চাপ সৃষ্টি ও সর্বোচ্চ সহায়তা প্রদান করি। জনগণের মধ্যে এরূপ দ্রুত বিচারের জন্য প্রচারণা চালাতে নেতৃত্ব দিই।
৭. সংস্কার কমিশন সমূহের কাজে সহযোগিতা করি এবং প্রয়োজনে নিজেদের মধ্যে আলোচনার ব্যবস্থা করে পরামর্শগুলো অধিক কার্যকর করতে সচেষ্ট হই। নিজেদের বিরোধের জায়গাগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখি এবং মিলের জায়গাগুলোকে বেশি বেশি সামনে নিয়ে আসি।

পরিশেষে বলতে চাই, মহান আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে ঐক্যবদ্ধ ও আন্তরিক থেকে বৈষম্যমুক্ত কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় যথাযথ ভূমিকা রাখার তৌফিক দিন। একই সাথে এরূপ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে যারা জালেমের বিরুদ্ধে লড়তে যেয়ে শহীদ হয়েছেন, পঙ্গু হয়েছেন, জুলুম-নির্যাতন ও ক্ষতির সম্মখীন হয়েছেন তাঁদের সাথে আমাদের সবাইকে ক্ষমা ও কল্যাণ নসীব করুন। আমীন।


১৮ জানুয়ারি ২০২৫ জাতীয় প্রেস ক্লাবে খেলাফত মজলিস, ঢাকা মহানগরীর আলোচনা সভায় উপস্থাপিত প্রবন্ধ।