খেলাফত মজলিসের আমীর মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক বলেছেন, দেশ এক গভীর সংকটকাল অতিক্রম করছে। সরকারের অদূরদর্শীতার ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মাত্রাতিরিক্ত উচ্চমূল্য, অসহনীয় লোডশেডিং, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। বৈদেশীক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। জাতীয় ঋণের বোঝা বাড়ছে আশংকাজনভাবে। ডলারের বিপরীতে টাকার অস্বাভাবিক অবমূল্যায়ন হচ্ছে। প্রয়োজনীয় তেল-গ্যাস আমদানী ব্যাহত হচ্ছে। এসব সংকটের উত্তরণ ঘটাতে হবে। দেশ ও দেশের মানুষকে রক্ষায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আজ (২৯ জুলাই) শুক্রবার সকাল ৯টায় রাজধানীল পল্টনস্থ সীগাল রেস্টুরেন্টে খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার সাধারণ অধিবেশনে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

আমীরে মজলিস মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাকের সভাপতিত্বে ও মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদেরের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত অধিবেশনে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সিনিয়র নায়েবে আমীর অধ্যাপক মাওলানা যোবায়ের আহমদ চৌধুরী, নায়েবে আমীর মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন, মাওলানা আবদুল বাছিত আজাদ, মাওলানা আহমদ আলী কাসেমী, অধ্যাপক আবদুল্লাহ ফরিদ, উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য মাওলানা জিয়াউল হক শামীম, ডা. আবদুল্লাহ খান, যুগ্মমহাসচিব এডভোকেট জাহাঙ্গীর হোসাইন, মুহাম্মদ মুনতাসির আলী, এবিএম সিরাজুল মামুন, ড. মোস্তাফিজুর রহমান ফয়সল, অধ্যাপক মোঃ আবদুল জলিল, সাংগঠনিক সম্পাদক ডাঃ এ এ তাওসিফ, মাওলানা তোফাজ্জল হোসেন মিয়াজী, এডভোকেট মিজানুর রহমান, প্রশিক্ষণ সম্পাদক অধ্যাপক কাজী মিনহাজুল আলম, আলহাজ আবু সালেহীন, মাওলানা শামসুজ্জামান চেীধুরী, ডা. শরীফ মোহাম্মদ মোসাদ্দেক, অধ্যাপক আবু সালমান, মুফতি ওযায়ের আমীন, মাস্টার সিরাজুল ইসলাম, মাস্টার আবদুল মজিদ, বোরহান উদ্দিন সিদ্দিকী, মুফতি সাইয়্যেদুর রহমান, মুহাদ্দিস শেখ মুহাম্মদ সালাহ উদ্দিন, ইঞ্জিনিয়ার মাহফুজুর রহমান, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ ফয়জুল ইসলাম, প্রকৌশলী আবদুল হাফিজ খসরু, মাওলানা নুরুজ্জামান খান, মাওলানা সাঈদ আহমদ, মাওলানা সৈয়দ মুশাহিদ আলী, প্রভাষক মোঃ আবদুল করিম, হাফেজ মাওলানা জিন্নত আলী, হাজী নূর হোসেন, মাওলানা আফতাব উদ্দিন, সাখাওয়াত হোসেন মোহন, মাওলানা আবদুল হাই, মুফতি আবদুল হামিদ, মাওলানা আবদুল হক আমিনী, ডাঃ রিফাত হোসেন মালিক, মাওলানা আজিজুল হক, ডাঃ আবদুর রাজ্জাক, খন্দকার সাহাবউদ্দিন আহমদ, তাওহিদুল ইসলাম তুহিন, মাওলানা সাইফ উদ্দিন আহমদ খন্দকার, হাফেজ মাওলানা আবু সালমান প্রমুখ।

অধিবেশনে সংগঠনের ২০২২ সালের অর্ধ-বার্ষিক রিপোর্ট পর্যালোচনা, শাখাসমূহের কাজের পর্যালোচনা করা হয় এবং সারাদেশে খেলাফত মজলিসের সাংগঠনিক কাজকে আরো জোরদার ও গতিশীল করার জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। অধিবেশনে একটি শোক প্রস্তাবসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও লোডশেডিং, রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তরণ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অপচেষ্টা ও সামাজিক অবক্ষয় এবং দেশে দেশে মুসলিম নির্যাতন প্রসঙ্গে ৬ টি প্রস্তাব গৃহীত হয়।

অধিবেশনে গৃহীত প্রস্তাবাবলী নিম্নরূপ :

প্রস্তাব-১: নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গ : খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার এ অধিবেশন গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করেছে যে, চাল, ডাল, তেল, আটাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। শিশুদের ২০টার এক বোতল নাপা সিরাপ এক লাফে ৩৫টাকা হয়ে গেছে। শিশু খাদ্যসহ সব জিনিসের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। দফায় দফায় জ্বালানী তেল, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি করা হচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষের নাভি:শ্বাস উঠেছে। আজকের এ অধিবেশন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জোর দাবী জানাচ্ছে।

প্রস্তাব-২ : অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও লোডশেডিং প্রসঙ্গ : খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার অধিবেশন গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছে যে, দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এক চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। দেশের বৈদেশীক মুদ্রার রিজার্ভ অস্বাভাবিকভাবে কমে যাচ্ছে। জাতীয় ঋণের বোঝা বাড়ছে আশংকাজনকভাবে। ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমছেই। ৮০/ ৮২ টাকার ডলার এখন ১১০টাকার উপরে। প্রয়োজনীয় তেল-গ্যাস আমদানী ব্যাহত হচ্ছে। তেল-গ্যাসের সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাওয়ায় লোডশেডিংয়ের অস্বস্তি বেড়েই চলছে। দেশে ঘুষ, দুর্নীতির অবস্থা চরমে। মেগা দুর্নীতির কারণে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ধ্বস নেমেছে। বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে সীমাহীন দুর্নীতি, বিদেশে অর্থ পাচার দেশের অর্থনীতিকে রুগ্ন করে ফেলেছে। আজকের এ অধিবেশন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিরাজমান বিশৃঙ্খলা দূর, সকল প্রকার ঘুষ-দুর্নীতি, অপচয়, অব্যবস্থাপনা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জোর দাবী জানাচ্ছে।

প্রস্তাব-৩: রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তরণ প্রসঙ্গ : খেলাফত মজলিসের মজলিসে শুরার অধিবেশন উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছে যে, দেশের রাজনৈতিক অঙ্গণে বিরাজমান সংকট জটিল অবস্থা ধারণ করেছে। দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংষ্কৃতি এমন পর্যায়ে গিয়েছে যে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও অবিতর্কিত নির্বাচন অনুষ্ঠান অসম্ভব। তাই রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে সকল দলের রাজনীতি চর্চার অবাধ সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এজন্য নির্বাচনকালীন একটি দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। জনগণের ঐক্যমত্য ছাড়া জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম চাপিয়ে দেয়া যাবে না। বিরোধী মতের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের উপর হামলা, মামলা, নির্যাতনের চর্চা বন্ধ করতে হবে। দায়েরকৃত হয়রানীমূলক রাজনৈতিক মামলা তুলে নিতে হবে। গ্রেফতারকৃত আলেম-উলামা ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের অবিলম্বে মুক্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রস্তাব- ৪: সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অপচেষ্টা ও সামাজিক অবক্ষয় প্রসঙ্গ :  খেলাফত মজলিসের মজলিসে শুরার অধিবেশন গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করেছে যে, বিভিন্ন সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইসলাম ও মহানবী সা. এর বিরুদ্ধে অবমাননার ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে, যা অত্যন্ত নিন্দনীয়। কিন্তু এ সব ঘটনার সুযোগে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়ী-ঘরে হামলা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের ঘটনা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। মূলত: দেশের বিরাজমান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে একটি অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টি করার জন্যই একটি মহল এসব ঘৃণ্য কর্মকাÐ চালাচ্ছে। সম্প্রতি নড়াইলে ধর্মীয় অবমানন ও পরবর্তীতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়ী-ঘরে হামলা, অগ্নিসংযোগের যে ঘটনা ঘটেছে এ অধিবেশন তার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করছে। একই সাথে এহেন ন্যাক্কারজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে সে জন্য সবাইকে সতর্ক থাকার আহŸান জানাচ্ছে। এ অধিবেশন আরো লক্ষ্য করছে যে, দেশে গুম, খুন, হত্যা, ধর্ষণ, মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। মানুষের জান মাল ইজ্জতের ন্যূনতম নিরাপত্তা নেই। সড়ক দূর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল থামছে না। মাদকের সয়লাব, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গণধর্ষণ, নির্যাতনের মত ঘটনা চলছেই। দু:শাসন, নৈতিক অবক্ষয় ও বিচারহীনতার সংষ্কৃতির কারণে এ পরিস্থিতির ক্রম অবনতি হচ্ছে। খেলাফত মজলিসের শুরার এ অধিবেশন হত্যা নির্যাতনসহ পৈচাশিকতা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থার দাবী জানাচ্ছে এবং আইনের শাসন কায়েম ও নৈতিক- ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপের জোর দাবী জানাচ্ছে। একই সাথে দেশের সকল বোর্ড পরীক্ষায় ধর্ম শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার জোর দাবী জানাচ্ছে।

প্রস্তাব- ৫: দেশে দেশে মুসলিম নির্যাতন প্রসঙ্গ : খেলাফত মজলিসের মজলিসে শূরার অধিবেশ অধিবেশন গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছে যে, অর্ধ শতাব্দিরও বেশী সময় ধরে ফিলিস্তিনী জনগণের উপর ইহুদীবাদী ইসরাইল হত্যা নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর যুগযুগ ধরে জাতিগত দমন পিড়ন, গণহত্যা ও বর্ববরতা শিকার। বাংলাদেশে আশ্রয়গ্রহণকারী ১০ লক্ষাধিক মজলুম রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে মিয়ানমারের কোন সদিচ্ছা দেখা যাচ্ছে না। চীনের উইঘুর মুসলমানদের উপর নির্মম নির্যাতনে থামছে না। লক্ষ লক্ষ উইঘুর মুসলমানকে নির্যাতন ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়েছে। আজকের এ অধিবেশন ফিলিস্তিন, আরাকান, চীনের উইঘুরসহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলমানদের উপর পরিচালিত হত্যা নির্যাতন ও নির্মূল অভিযান অবিলম্বে বন্ধের জোর দাবী জানাচ্ছি।

৬. শোক প্রস্তাব : খেলাফত মজলিসের মজলিসে শূরার এ অধিবেশন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ, খেলাফত মজলিসের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য নোয়াখালীর বিশিষ্ট আলেম মাওলানা হারুনূর রশীদ, খেলাফত মজলিসের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও মৌলভীবাজার উলামা পরিষদের সভাপতি মাওলানা আবদুল বারী ধর্মপুরী, চট্টগ্রাম পটিয়া মাদরাসার মুহতামিম ও আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিস বাংলাদেশের মহাসচিব মুফতি আবদুল হালিম বোখারী, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য কুড়িগ্রামের বিশিষ্ট আলেম মাওলানা রিয়াজুল হক কাসেমী, খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের দীর্ঘদিনের অফিস সহকারী আবদুল মালেক, ঢাকা মহানগরীর কদমতলী থানার সহসভাপতি সোহরাব হোসেন, খেলাফত মজলিস বার্মিংহাম শাখার সহসভাপতি আলহাজ্ব সৈয়দ ফজলুস সামাদ ও নোয়াখালী শহর শাখা সভাপতি মাওলানা এটিএম ফখরুল ইসলাম এর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে মরহুমদের রুহের মাগফিরাত কামনা করছে। এবং গত ৫ জুন সীতাকুন্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকান্ডের ঘটনায় বহু মানুষ হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করে সকলের রুহের মাগফিরাত কামান করছে ও শোক সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করছে।